উৎপলকুমার ও তাঁর অভিকর্ষ

অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়


পৃথিবী থেকে দূর মহাবিশ্বেঠদিকে যাত্রা করা মহাকাশযান অনেকসময় শক্তিশালী গ্রহের à¦®à¦¹à¦¾à¦•à¦°à§à¦·à¦•à§‡à ‡ গুলতির মত ব্যবহার করে মুক্তিবেগ অর্জন করার জন্য। সেইসব গ্রহের অভিকর্ষের কাছে কিছু ভর সমর্পণের বিনিময়ে তার কক্ষপথের উল্লেখযোগ §à¦¯ পরিবর্তন ঘটে যার ফলে কম শক্তিতে এই মুক্তির আনন্দ হস্তগত হয়।
আটের দশকের মাঝামাঝি মফসসলের একটি কিশোরের ষোলো-আঠেরো থেকে কুড়ি-পঁচিঠ¶ বছর বয়সের কাব্য পরিক্রমার ব্যপারে এটি একটি সুন্দর রূপক হতে পারে। রবীন্দ্রনঠথ-à¦•à§‡à¦¨à§à¦¦à§à¦°à¦¿à ¦• সৌরজগত থেকে বেরিয়ে আমাদের সেই ভয়েজার জীবনানন্দৠর সৌরজগতের দিকে যাত্রা করে, তারপরে সুনীল-à¦¶à¦•à§à¦¤à ¿-শরত প্রমুখের সৌরমন্ডলে, এই কক্ষপথ বদলে বেশ কয়েকজন অনন্য এককের কলমের শক্তিশালী টানের একটা ব্যপার আছে সেটা আমরা অনেক সময় খেয়াল করে দেখি না।
প্রথম বাঁক বদলের প্রণোদনা যদি সুধীন্দ্রঠাথ-বিষ্ণু দে-à¦¬à§à¦¦à§à¦§à¦¦à§‡à ¬ বসুর কলম থেকে এসে থাকে, পরের পর্যায়ে যে দুজনের নাম একেবারে প্রথমে মনে আসে, তাঁরা হলেন উৎপল কুমার বসু আর বিনয় মজুমদার ।
উৎপল কুমার বসুই কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন ,” কবিতা, আমরা জানি, কোনো স্বয়ংসম্পৠর্ণ বস্তু নয়। কবিতা, পাঠক ও কবির মধ্যে এক প্রতিক্রিৠা সৃষ্টিকারৠপদ্ধতি। .....কবিতায় আমরা প্রায়শঃ শ্বসিত বস্তু বা অরগ্যানিক অস্তিত্বেঠ° চিহ্ন দেখে থাকি।“
বিজ্ঞানের, জীবনবিজ্ঞঠনের ছাত্ররা জানেন এমন জীবনের এমন কিছু মৌলিক উপাদান আছে, যা জীবন্ত কোষকলার সংস্পর্শে এলে তবেই তাতে প্রাণের লক্ষণ দেখা দেয়, তারা সংখ্যায় বাড়ে, ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের আলোকিত রাস্তায় উৎপল কুমারের ভাবনার অনুসরণ করে বলা যায়, কবিতা পঠিত হয়, প্রতিক্রিৠা-স্বরূপ জীবনলাভ করে, অন্যকে সুপারিশ করা হলে পুনঃপঠিত হয়, ও তার কিছু পরেই তার পরিসমাপ্তি (নশ্বরতার চূড়ান্ত), আরেকটি নতুন পাঠ বা পাঠকের সংস্পর্শে আসার আগে অবধি। বস্তুতঃ জীবনের অভিজ্ঞতাই সেই শ্বসিত বস্তু যা কবিতার কাঠামোয় প্রাণসঞ্চা র করে, যা ছড়িয়ে পড়ে পাঠক থেকে পাঠকে।
যদি কবিতা সম্পর্কে কবির এই অনুভবের কথাটা মাথায় রাখি, উৎপল কুমার বসুর কবিতাকে এমনকি তাঁর সমসাময়িকদৠর থেকেও একদম আলাদা করে চিনে নিতে আমাদের সুবিধে হয়।
একজন জীবনবিজ্ঞঠনী যেমন পেট্রি-ডিশৠ‡ বিভিন্ন প্রাণকণিকঠ¾à¦° à¦œà§€à¦¬à¦¨à¦šà¦•à§à¦°à§‡à ° নিরীক্ষার ফল ক্রমাগত লিপিবদ্ধ করতে থাকেন, কবিও তেমনি তাঁর রচনায় শ্বসিত বস্তুর, নশ্বর পৃথিবীর উপঢৌকনকে বারবার অসীম অনন্ত কালের পরিপ্রেক্ঠ·à¦¿à¦¤à§‡ দাঁড় করিয়ে নিরীক্ষণ করেছেন নিরাসক্ত দ্রষ্টার মত।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রনৠà¦¥ চৈত্রে রচিত কবিতা-র কিছু লাইনতেই সুস্পষ্ট -
“বুঝি চিরজাগরূক
আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে –
সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি । “ (চৈত্রে রচিত কবিতা ১)
উৎপল বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, পেশায় ভূতত্ত্ববঠদ। চিরপরিবর্ত নশীল এই পৃথিবীর জন্মকাল থেকে আজকের ভূ-à¦¸à¦‚à¦¸à§à¦¥à¦¾à¦¨à ‡à¦° কথা মাটির স্তরে স্তরে, আকরে আকরে যেভাবে লিপিবদ্ধ থাকে তার পঠন ও চর্চা বা আবিষ্কারই কবির মনে এই ভাবনার জন্ম দিয়েছিলো কি না জানি না, তবে হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাটির কথা এভাবেই উঠে আসে –
"মাটির গর্ভ খুঁড়ে আমরা অর্জন করি লোহার আকর
এত লোহা কাদের মঙ্গলে পরস্পর প্রতিবন্ধৠগড়ে তোলে
এঞ্জিন ,স্তব্ধ রেল,সাঁকো , বাড়ি , কলোনী , বাজার- "
সম্ভবতঃ ভূতত্ত্ববঠদ্যার প্রভাবেই কবির এই অর্জন – "à¦¦à§‚à¦°à¦¬à§€à¦•à§à¦·à £ নামে আশ্চর্যজনঠবিদ্যা আমারও আয়ত্ত্ব ছিল।" (আ পু সী , মধু ও রেজিন ২) এই দূরবীক্ষণ শব্দটি এক্ষেত্রে একটু বিশেষ বীক্ষণ দাবি করে বলে আমার মনে হয়। শুধু কি দূরকে দেখাই দূরবীক্ষণ? না কি পরমুহূর্তৠনিকটকে স্পর্শ করাও তাঁর এই বিশেষ বীক্ষণের অন্তর্গত? ইংরাজিতে à¦Ÿà§‡à¦²à¦¿à¦¸à§à¦•à§‹à¦ªà ¿à¦• বিশেষণটা শুধু দৃষ্টি বিষয়ে নয়, সেইসব বস্তু বা বিষয় সন্মন্ধেও প্রযোজ্য যাদের প্রয়োজনমত সংকুচিত ও প্রসারিত করা যায়। ভূতত্ত্ববঠদ্যায় যেভাবে পৃথিবীর জীবত্কাল কে মহাযুগ বা কল্প, উপকল্প এবং যুগে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রয়োজনমত তার অধ্যয়নকে প্রসারিত বা সংকুচিত করা যায়, তেমনি কবির কলমে পৃথিবীর আদিম প্রাচীন সেই সময়ের থেকে দৃষ্টি মুহূর্তে ঘটমান বর্তমানে নীত হয়...
" হে সূর্য, কুকুদবৃষ, সাবলীল সোনার গাছের
প্রচ্ছায়াৠŸ, অন্ধকারে সমস্ত তৃণের রোমে একই সঙ্গে
ক্ষুধা ও চুম্বন
রেখেছো স্তম্ভিত করে। হে সূর্য, উদ্ভিন্নবঠহু তুমি পরাঙ্মুখ
আমাকে দাও নি ধান, গোলাঘর, বীজের উত্থান
আমাকে দাও নি সার, বৃষ্টিজল, কূপের বিন্যাস
আমাকে দাও নি শেষ জলসিঞ্চনেঠমত জননীপ্রতিঠা" (পু সী, ফেরীঘাট)
আসলে সূর্যই তো সেই উর্বরতার উত্স, - জীবনের কারণ, আবার জীবনের পালক, ক্ষুধা ও চুম্বন (যা খাদ্য তৈরিতে সহায়ক) দেনেওয়ালা. তাকেই কি বৃষ বলা হচ্ছে, উর্বরতার বৃষ। আবার সে-ই পরাঙ্মুখ, কারণ সে একদম আদিম জীবনের বাইরে আর কোনো উপঢৌকন নিয়ে আসে না। কোন সংকেত, সংবাদও নয়।
অথবা অন্যত্র
"হেসপারাস, আশ্চর্য নক্ষত্র তুমি এখনো এলে না,
ওদিকে বিকেল ক্রমে পড়ে এল – মহাদেশ ফেটে যে চৌচির
বিড়ালীর বাঁকা নখে – বিড়ালী কি নাবিক তোমার?
তোমার সন্তান? সেনা? সেকি এ জন্মের তিরস্কার?" (আ পু সী , যুদ্ধের ডাক ২)
হেসপারাস সন্ধ্যাতার া। সেই তারাই ব্যবিলনে দেবী ইশতার, আর গ্রীসে ভিনাস। তারপরেই মহাদেশ ফেটে চৌচির হবার প্রসঙ্গে মনে পড়তে বাধ্য জিওলজিস্টঠের সময়-à¦¬à§€à¦•à§à¦·à¦£à ‡à¦° কথা, যার গণনা সততই লক্ষ কোটি বছর নিয়ে, এক আধ হাজার বছর স্রেফ কয়েক পা চলার মত। নানান পুরাণকথার মধ্যেই প্রাকপুরাঠকথার রেশ এভাবে জড়িয়ে যায়, আবার বা একদম তাত্ক্ষণিঠে, রোজকার দিনযাপনের ছবিতে ফিরে আসে, যেমন,
"বৃষ্টি শেষ হলে আমি ভোরবেলা বাগানে নেমেছি
পাঁচটায় তোমাদের ট্রেন এসে পৌঁছয় স্টেশনে –
.....আমাদের এদেশে এবার
চাষবাস ভালো হল –শাকসব্জি উঠেছে প্রচুর –
পুকুরে নরম মাছ – হাঁসের নতুন ডিম – রিক্সয়
যদি-বা আসো চার আনায় পৌঁছে দেবে ওরা ।" (আ পু সী , কুচবিহার )

সলমা জরির কাজ-য়ের উত্সর্গপতৠà¦°à§‡ লেখা "আমাকে নাচতে দাও ওগো ওই পাথরটুকুর পরে ঘূর্ণিপাকৠ‡à¦° মত জায়গা ছেড়ো.. এসো নাচবুদ্ধি দিয়ে সবকিছু জেনে ফেলি।" কে না জানে, নাচের হৃদ্স্পন্দ ন হচ্ছে তাল, সময়ের বোধ। এই à¦Ÿà§‡à¦²à¦¿à¦¸à§à¦•à§‹à¦ªà ¿à¦• সময়ের বোধিই কবির কবিতার চাবিকাঠি।
এই আপাত নশ্বরতা ও পুনর্জীবনৠর চক্রে গ্রথিত চিরপরিবর্ত নশীল বস্তু জগতের মধ্যে কি কবিতার সত্যের প্রতিরূপ উৎপল কুমার লক্ষ্য করেছিলেন? ...একটি এককের আয়ু তিল পরিমাণ অথচ, এরকম অগণ্য এককে প্রাণের ধারা বহন করে চলা-র? মানুষের জীবন যত দীর্ঘায়তই হোক না কেন, তার মধ্যে কুড়ি-তিরিঠ¶,বড়জোর তিরিশ-চল্লঠশ বছর তার ফলবান খন্ড। এই নশ্বরতার, এই কালসীমার মধ্যেই তার যা কিছু ফসলের কারবার। ফলতঃ ব্যপারটা অনেকটা নুনের পুতুলের সাগরে সত্ত্বাবিল োপে পরিসমাপ্তি বর্ণনা করা গেলেও,আসলৠব্যপারটা নুনেরই পুতুল, নুনেরই সাগর। কিছুদিন পর্যন্ত্য। আরো এক মহাযুগ, আরো অনেক বিক্রিয়ার পরে হয়তো কোথায় নুন! আর কোথায় বা জল! তাহলে দেখা যাচ্ছে একমাত্র নশ্বরতাই বহমান, শাশ্বত, যেমন বাগানে মাটি চাপা দেওয়া হাড়ের টুকরো –
“জন্ম নিতে পারি-আমি
হাড় হয়ে জন্ম নিতে চাই, চাই
বাংলোর খ্যাপাটে বাগানে
একা পড়ে থাকি...
শেষতম হাড়, তার খুলে ফেলা ত্বক
মাটি দিয়ে অন্তরাল করো দ্রুত
ঘাস চাপা দাও“ (খলসামগ্রী, খন্ডবৈচিতৠর্যের দিন)
হাড়ের দিন শেষ, কিন্তু প্রকৃতির তাড়া তাতে কমছে না, দ্রুত মাটি চাপা দিয়ে তাকে à¦…à¦¨à§à¦¯à¦•à¦¿à¦›à§à¦¤à ‡ পরিবর্তিত করে ফেলতে হবে ...যা সম্ভবত হাড়টিরও অজানা নেই।
অথচ এই নশ্বরতার স্পর্ধাতেঠহালেবিদ মন্দিরের পাথরের চিরযৌবনা যক্ষিণীকে আহ্বান –
“এসো, আমাদের সামান্য আশ্রয়ে একদিন
থাকো, আতিথ্য গ্রহণ করো, আমাদেরই সংসারের
উত্থানপতনৠভ্রষ্ট হও,জয়ী হও,
আমাদের আলনা শেয়ার করো, এই তাকে বই রাখো,
কার্তিক সন্ধ্যার প্রথম শ্যামাপোকঠ¾ দেখে বিষণ্ণ হও,
আমাদের সংসারের উপর চিরদিন কালো মেঘ, অনেক ঝড়, অনেক বজ্রপাত
দ্যাখো সে-সৌন্দর্ঠ¯ তোমার চেয়ে কিছু কম বিষাক্ত নয়।“ (শ্রেষ্ঠ কবিতা, অগ্রন্থিত, শিরোনামহীঠ¨)
বলা বাহুল্য এ বিষ ঠিক সেই বিষ নয়, অমৃতে গরলের বদলে, গরলে অমৃতের প্রস্তাবনা । নশ্বরতার জিত এখানেই –
“নশ্বরতা তাই চায় প্রাণ
চায় কাচের বাসনপত্র, মাটি দিয়ে তৈরী ফল।“ (তদেব)
আবার যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করি। আমার কৈশোরে আমি যখন উৎপল কুমারকে প্রথম পড়ি, তখন সে বুঝি ছিল কথিত মহাকাশযানৠর জানালা দিয়ে দেখা বিপজ্জনক আকর্ষণের এক গ্রহ। অনেক বছর পরে, কবিতার সাথে অভিমান, বিচ্ছেদের পালা সেরে যখন এক নবলব্ধ নির্লিপ্তি তে থিতু হলাম, তখন আবিষ্কার করলাম গ্রহ নয়, এ এক স্বয়ং-সম্পৠ‚র্ণ জীবন্ত সৌরজগত।
অবশ্য এটা একান্তভাবৠআমারই দেখা, তাহলেও ব্যক্তিগত অনুভব অন্য উত্পল-à¦…à¦¨à§à¦°à ¾à¦—à§€à¦¦à§‡à¦° সাথে ভাগ করে নেবার প্রথম পদক্ষেপ, খন্ডিত বীক্ষায়, অকুশলতায়। আর সে প্রশ্রয়, অনুমতি তো স্বয়ং কবিই দিয়ে রেখেছেন –
“একদিন, যখন সময় হবে, বোসো এই কাব্যের পাশে।
একে ভাঙা টেবিলের মত তুমি কাছে টেনে নাও। রাখো গরম পেয়ালা
এরই অক্ষরের পরে। জলের গেলাস রাখো।...
একে দিয়ে ভূতের বেগার খাটাও যত খুশি। তুলে দিই তোমার আঙুলে।“

ফেসবুক মন্তব্য